বড়গল্প_বিভাগ
এখন ইন্দু কেমন আছে
প্রবীর তা
(এক)
Oindrila Das |
(দুই)
সপ্তাহের প্রথম দিন সোমবার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই ঐন্দ্রিলার লক্ষনগুলো ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে লাগল।
প্রথম দু দিন অতটা সিরিয়াসলি নেয়নি শোহিনিও। টুকটাক শরীর খারাপ হতেই পারে। এই ভেবে পাড়ার চাইল্ড স্পেশালিস্টকে দেখিয়ে ভিটামিন সহ একটা হালকা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্ষ করিয়ে এনেছিল সর্দি-জ্বরের। বুধবার বিকেল হতেই তার সন্দেহের উদ্রেক হয়। এবং আর ও কয়েকটা প্রহর পেরিয়ে বৃহস্প[তিবার বিকেলেই তার ধারণা দৃঢ়বদ্ধ হয়। খারাপটা শরীরে যত না...তার চেয়েও মনে। এই ধারণা স্পষ্টতা পেতেই সে বুঝল এ ওষুধে তার বিন্দুমাত্র কাজ হবে না।
কিন্তু মনের দরজাটাও ঐন্দ্রিলা এমনি বন্ধ করে রেখেছে যে শত কৌশলেও তা খুলতে ব্যর্থ শোহিনি। না হবে কেন ? ঐন্দ্রিলা তো জানে বাবা-মাকে বল্লেই বিপদ তার বাড়বে আরও বেশি, কনা তো দূরস্থান। তখন তার বেঁচে থাকাই দায় হবে।
স্কুলের দিদিরা পঁই পঁই করে বলেছে সে কথা। শাসানো বাক্যগুলো হিমেল বরফের নিশিত ফলার মতো তার ছোট্ট মগজের ভিতর ঢুকে ফালা ফালা করে দিয়েছে বুকের সব সাহস শক্তিকে।
- খবরদার ইন্দু, যদি বাবা-মা কাউকে বলিস তবে তোর চারা নেই। এবার আর ইউরিনালে নয় ওই অন্ধকার গুমটিতে গোডাউনে পুরে রাখব। সারা দিনরাত না খেতে পেয়ে কঙ্কালসার হয়ে মরবি পচে পচে। কেউ জানতে পারবে না কোনোদিন।
পাশের দিদিটাও যোগ করছে- এই শোন, একটা কথা মনে রাখবি তোর বাবা-মা তোর সঙ্গে থাকবে না স্কুলে। তোকে একাই থাকতে হবে পড়তে হবে। কোন ম্যাডামও তোর সঙ্গে লেগে থাকবে না। আমরাই থাকবো তোর পাশে পাশে -বুঝলি তো ?
ঘর্মাক্ত কলেবরে পাংশুমুখে একরাশ শূন্যদৃষ্টি মেলে চেয়েছে দিদিদের পানে। বিষ্ময় আর হতাশার কালো-গহ্বরে ডুবে যেতে যেতে। পরক্ষণেই আর একটা দিদি চকিতে তার বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলেছে কি রে বুঝেছিস তো ?
যন্ত্রচালিতের ন্যায় বোবা মুখে চমকে উঠে সে ঘাড়টা ঘুরিয়েছে নব্বুই ডিগ্রি। লম্বা প্রতিশ্রুতি -হ্যাঁ তাই হবে' অব্যক্ত শারীরিক ভাষা।
- হ্যাঁ, যদি তের বাবা-মা বা অন্য কোন গার্জেন কোন ক্রমে ম্যাডামদের কানে তুলেছে না -তা হলে জানবি তুই শেষ। একইভাবে সম্মতির বোবা ঘাড়টা আরও নিচু করেছে ঐন্দ্রিলা।
গত সপ্তাহের শুক্রবার থার্ড পিরিয়ড শুরু হবার মুখে ঐন্দ্রিলা যখন একা টয়লেটে যায় তখন উঁচু ক্লাসের স্কার্টপরা তিনটে দিদি ছিল সেখানে। তবু সে বলে -উঃ... এ নিয়ে দু বার।
- না পাঁচবার এরি মধ্যে। এই দ্যাখ তোর নামের পাশে নোট আছে। মনিটরিং কার্ডটা বার করে ঘোরালো একবার নিজের হাতেই।
- খোল শিগগির... প্যান্টি খোল -দেখি সাইজটা। আরও চিৎকার করে ধমক দিয়ে ওঠে পাশের মোটা দিদিটা। নিলে এখনেই লক করে দেব। সারাটা দিনরাত বসে বসে যত পারিস ফিরবি।
ঐন্দ্রিলার নরম দৃষ্টিটা কুঁচকে যায়। লজ্জা-মান সবকিছু ছাপিয়ে ভয়ার্ত একটা হিমেল চোরা স্রোত মগজ থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসে চকিতে। কাঁপাঁ-কাঁপাঁ হাত দুটো দিয়ে সে প্যান্টিটা নিচে নামায়। হাঁটুর উপরে। পার পায় না তাতেও। পরক্ষণেই গোড়ালি ছাড়িয়ে সমস্ত পোষাক অঙ্গমুক্ত অর্থাৎ দিগ্বসনা হবার নির্দেশ। শেষনেষ তাই করতে হয় ঐন্দ্রিলাকে। ছোট্ট কৃশকায়া ঐন্দ্রিলা হয় দিগ্বালিকা। দিদিরা সে দৃশ্য দেখে মুখে তেমনি রুমাল চেপে ক্রূর হাসি হাসতে থাকে। পরক্ষনেই তারা ঐন্দ্রিলাকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে বাইরে থেকে লক করে পালিয়ে যায়।
দিদি গুলো ফিরে আসে আবার। একেবারে শেষ পিরিয়ডে। স্কুল আওয়ারের একেবারে শেষ মুহূর্তে। মাঝখানে আরও কতবার কে জানে। পালা করে ফিরে ফিরে এসে তারা দাঁরিয়েছে নিঃশব্দে বন্ধ দরজার পাশে। কান পেতে শুনেছে ভিতরে বন্দি ছোট্ট প্রানিটির নড়াচড়া। অস্তিত্বের স্ফট-অস্ফট শব্দ ভাষা কে জানে। মাঝখানে অতিক্রান্ত প্রায় ঘন্টা তিনেক।
ততক্ষণে বে-আব্রূ ছোট্ট শরীরের সব লজ্জা অপমান ঢোকে ফেলেছে ঐন্দ্রিলা। আরাধ্য বাগদেবীর পূত সাধনালয়ে সুনির্দিষ্ট শূচিশূধ্য পোষাকে। স্কুল ইউনিফর্ম। ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে দু চোখ হতে অবিরাম বোয়া অশ্রুধারা। পরিবর্তে নির্জন রুদ্ধ ঘরের সব অন্ধকার ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে একটু একটু করে প্রবেশ করে দানা বেঁদেছে তার মগজে। যদিও বাইরে তখন দিনমণির অপার উজ্জল আলোর ঝলমলে কলতান দিনমান। স্কুল চত্ত্বর ভর খেলার মাঠ জুরে সঙ্গীদের দাপাদাপি হাসি হুল্লোর। টুকরো টুকরো ভেসে এসেছে তার কানে। তবুও অন্ধকারে আবর্তিত কষ্ট গুলো ছোট্টবুকের ভিতর অবিরাম তোলপাড়িয়ে উঠেছে আর মোচর দিয়ে ছোট্ট শরীর জুড়ে দাপাদাপি শেষে ক্লান্তিতে অবশ করেছে দেহ-মন। ছুটির ঘন্টা বেজে গেল ঢং.. ঢং.. ঢং.. ঢং.. ং তারপর ক্রমশঃ থিতিয়ে আসা নিঃশব্ধ হয়ে আসা বাইরের সব কলরব কলতান পদচারণার সংঘবদ্ধ বিক্ষেপ সব মিলিয়ে যায়। বন্ধি উৎকর্নে তার কোন শব্দ-সুর ভেসে আসে না। যে ঘন্টা শুনলেই সহসা বুকের ভিতর চলকে উঠত একখন্ড আনন্দ সুখানুভূতি, আর এখন তার পরিবর্তে ঐন্দ্রিলা ভাবে আর বুঝি ওখানে সে ফিরতে পারবে না কোনোদিনও। আর একটি বারও মিলিত হতে পারবে না সঙ্গী-সাথীদের সাথে। ক্লাসে-পথে-স্কুল চত্ত্বরে।
বাবা-মার মুখটা মনে পড়ে আবার। তাদের শঙ্গেও আর কোনোদিন দেখা হবে না। এই তো এক্ষুণি সে মরে যাবে। অন্ধকারে হারিয়ে যবে মিশে যাবে চিরদিনের জন্য।
আর তক্ষুণি পাল্লার বাইরে থেকে লক্ খোলার শব্দ কানে ঢোকে। সেই দিদিগুলোই ঘরে ঢোকে আবার। নেতিয়ে পড়া ঐন্দ্রিলাকে ধরে তোলে। চোখে-মুখে জলের ছিটে দিয়ে সজাগ করে তোলার চেষ্টা করে। তারপরই শাসানোর পর্বটা শুরু হয় ; শোন তোর সঙ্গে যা হল এসবের কিছুই যেন বাবা-মাকে বলবি না ইত্যাদি। ক্লাস থেকে যথাসময়ে নিয়ে আসা ব্যাগটা দেয় ওর হাতে।
তবু এটুকু প্রশ্নচিহ্ন উঁকি দিল না কোথাও --একটা ছোট্ট মেয়ে স্কুলে এসেও প্রায় ঘন্টা তিনেক উধাও হলো কোথায় ?
দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে সেদিনের মতো কোনমতে বাড়ি ফিরে আসে ঐন্দ্রিলা। এসেই তার শরীর মনজুড়ে কি যেন এক অনাবয়ব ভয় চেপে বসে। ক্রমশঃ অসুস্থতা অনুভব করে।
(তিন)
পরের দিন শনিবার। অফিস থেকে সন্ধের একটু আগেই ফেরে শান্তনু। ঐন্দ্রিলা তখন ছাদে। সূর্য ঢলেছে পশ্চিমে। পরপারে যাবার আয়োজন শুরু হয়েছে তার। দিগন্তে তারই অন্তিম মেদুর রক্তিম দ্যুতির আভাটুকু ছড়িয়ে দিয়েছে। অপ-সৃয়মান সেই দ্যুতির কয়েকটা টুকরো ঝলক এসে পড়ছে ছাদের ছোট্ট ফুলবাগানে। কার্নিশে সারি সারি সিমুন্ড টবে। রঙ বাহারি গোলাপ রজনীগন্ধা, বেলি, টগর, গন্ধরাজ আরও কত দেশি-বিদেশি প্রজাতি। ঐন্দ্রিলার ছোট্ট দুটি করতলের অপার স্নেহস্পর্শ লেগে আছে যাদের সারা শরীর জুড়ে। নিজ হাতে যাদের জলপান করায় দুবেলা নিয়ম করে। কিন্তু আজই প্রথম ব্যতিক্রম হয়ে যায় সে নিয়মের। তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কার্নিশে হেলান দিয়ে ঠায় চেয়ে আছে দূর দীগন্তে।
অমনি কোথা থেকে একটা গঙ্গাফড়িং লাফিয়ে এসে বসল বেল কুঁড়ির ঝারে। ধূসর ডানা মেলা একটা প্রজাপতিও চকিতে উড়ে গেল পাশের ছাদে। সেদিকে দৃষ্টি পড়লেও তেমনি উদাসীন ঐন্দ্রিলা।
অন্যদিনে একঝলক হাসি ছড়িয়ে দিয়ে অমনি দেখামাত্র সে ছুটে যেত গঙ্গাফড়িং-টার পিছু। লম্বা ঠ্যাঙে ঘন সবুজাভ সেটাকে ধরতে। কোনমতে তা পারলেই মেয়েকে রোখে কে ? একছুট। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা কিচেনে। মায়ের কাছে। দ্যাখো মা-মণি এটাকে পুষব। একটা বোতলে পুরি ?
- না ছেড়ে দাও ; ওকে বন্দি কোরো না। ওর কষ্ট হবে না ? মরে যাবে। কত ছোট্ট প্রান দেখতো। থরথর করে কাঁপছে তুমি ধরেছ বলে। বাবা-মা কে দেখতে পাবে না। তোমাকে যদি কেউ ওভাবে বন্দি করে ?
- মায়ের কথা শুনে দুচোখে একরাশ বিষ্ময় উপধে পড়ে। হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছ মা-মণি, যাই ছেড়ে দিযে আসি ?
-হ্যাঁ। ও তো আবার আসবেতোমার কাছে। তুমি ভালোবাসলেই ও তোমার পোষা হয়ে থাকবে দেখো।
- সত্যি !
হ্যাঁ সত্যি... সত্যি। তুমি সবাইকে যত ভালোবাসবে দেখবে সবাই তোমার প্রিয়জন। পোষা হয়ে থাকবে। গোটা জগৎটাই।
ছোট্ট ঐন্দ্রিলা মায়ের ভালোবাসার তত্বের অত গভীরে না ঢুকতে পারলেও বুঝেছিল ষালোবাসাই শেষ কথা। ভালোবাসা দিয়েই সব জয় করা য়ায়। তেমনি ছুটে ছাদে উঠে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল ফড়িংটাকে। ছাড়া পেতেই সেটা আকাশ পানে উড়ে গিয়েছিল। সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে সে খুশিতে ডগমগ। বলেছিল- যা তুই মুক্ত। রোজ রোজ অত পড়া মুখস্ত তো আর করতে হয় না, বুঝবি করে বন্দি দশা বলে কাকে ? এবার আমি ম'লে তোর মতোই হবো, উড়ে উড়ে বেড়াব ছাদে ছাদে। যতসব আগানে বাগানে। দেখবি তখন ঠিক তোর সঙ্গী হবো। এখানে তো আর বাগান নেই। -য তুই দূরে। চিনতে পারবি তো তখন আমায় ?
কিন্তু আজ ! তার ব্যতিক্রম হল। ওটাকে দেখেও ছুটল না তার মন। বরং নিস্পৃহ। উদাসীন শূন্য চোখেই চেয়ে রইল দূর দীগন্ত পানে। অনুরণিত হতে লাগল স্মৃতিতে ক'দিন আগের মায়ের বলা কথা গুলো - কত ছোট্ট প্রান দেখতো তোমাকে যদি ওভাবে কেউ বন্দি করে রাখে। মনে পড়তেই কষ্টটা আবার শুরু হল। ঘুরপাক খেতে খেতে বুকের ভিতর ওঠানামা করে। স্কুল ল্যাটিনে অবরুদ্ধ অন্ধকারগুলো আবারও তার সারা শরীর মনটাকে গ্রাস করে। দুফোঁটা অশ্রু দুচোখের কোল ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়ে গালে। দিগন্তে সূর্যটা দপ করে নিভে যায়। অমনি দিগ্বলয় হতে হু হু করে ছুটে আসে রাশি রাশি অন্ধকারগুলো। দুপাশের সব গাছ-গাছালি-রাজপথ-অট্টালিকা শহরটাকে টপকে তার ছাদের উপর।
তখনি নীচে বাবার ভারী কণ্ঠস্বরটা ভেসে আসে। ঝাঁজালো কণ্ঠস্বরে মার কাছে কৈফিয়ত নেয়- কেন স্কুল কামাই করল ? দু-সপ্তাহ পরই পরীক্ষা জানে না ও ? তারপরই আরও চিৎকার করে উঠল-- ইন্দু... ইন্দু নেমে এস শিগগির। স্কুল যখন যাওনি পাঠগুলো তৈরী করে রেখেছ ঠিক। দেখি এখন।
কণ্ঠস্বরটা কানে যেতেই কাঁপন উঠল ঐন্দ্রিলার শরীরে। যেন কতকালের অচেনা মনে হল তার। এমনটা কবে হয়েছে মনে করতে পারল না। দ্রুত দুগালের অশ্রু মুছে ধীর পদক্ষেপ বাড়াল সিঁড়ির দরজায়।
সব শনিবার সম্ভব না হলেও প্রায় প্রত্যেক রবিবার মেয়েকে পাশে নিয়ে বসে শান্তনু। আজও তার ব্যাতিক্রম হল না।পাশে বসে কিছুক্ষণের বিনিময় হতেই বিরক্তি প্রকাশ শুরু করল শান্তনু। তারপরই খাতা-পেন-বই সব ছুঁড়ে দিল। আছড়ে পড়ল ঐন্দ্রিলার কোলের উপর। অসহায় (এক) গভীর শূন্য দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে থাকে সে বাবার রক্তচোখের পানে। তা দেখার অবকাশ পায়না শান্তনু। শোহিনির দিকে মুখ ফিরিয়ে শুনিয়ে যায় -দেখেছ কি আবস্থা করে রেখেছে সব। একটা পাঠও তৈরি করেনি সারাটা দিন। কি এর দেখবে ! এই করে কি স্টান্ডটাকে ধরে রাখতে পারবে ভেবেছ ! ওদিকে দেখ, ওদের জুলিকে। কিভাবে একটানা সাতানব্বই আটানব্বুই পারসেন্ট ছরে রেখেছে ; এই হচ্ছে মেয়ে। বলতে বলতেই উঠে পড়ে শান্তনু।
অস্থির পায়চারিতে ঘুরে ফিরে আবার আসে কন্যার কাছে। হাজার বিরক্তি উগরে আবার বলে - এই শোন্ ইন্দু, এগুলো সবই দেওয়া আছে, ফের কাল সন্ধ্যেয় বসব তৈরি করে রাখ কিন্তু।
ভাঙতে ভাঙতে ভিতরের অবশিষ্টটুকুও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে থাকে ঐন্দ্রিলার। নীরব চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে টুকরো টুকরো সেই অসহায় বিষম-বিপন্নতার নিদারুণ চিহ্ন।
কিন্তু আজকের শান্তনুরা যদি একবার সযত্ন প্রয়াস পেত, ঘরে ঘরে তাদের ছোট্ট ইন্দুদের অমন গভীর শূন্য দৃষ্টির মর্মন্তুদ দ্যোতনার সামান্যতম পাঠও যদি পেত !
হায় ! তা আর হয় না। পাশের জুলিরা যে অ-নে-ক দূরে ফেলে দিয়ে তর তর উঠে যায় সিঁড়ি বেয়ে স্বপ্নের সেই ইপ্সিত স্বর্গরাজ্যে। আর এমন প্রিয়তম পুত্র-কন্যকে তো আর তার বাবা-মা নিজের চোখে দাস-দাসি দেখতে পারবে না। তাই পরের দিন ছুটির দিন রবিবারও একই খটনাট পুনরাবৃত্তি ঘটে।
এমন ছুটির দিনে সকাল-বিকেলের অনেকটা সময় যে ঐন্দ্রিলা সকাল-বিকেল অনেকটা সময় ছাদে কাটায় পাখি-প্রজাপতি-গঙ্গাফরিং-র সাথে কত কথা বলে, সেই ঐন্দ্রিলা বারের জন্যো ওটে না ছাদে।
বি-খাতা-পেন-র স্তুপের সামনে বসে থাকে সারাটাদিন। তবুও মগজে তার রাশি রাশি মরা কালো (ইদানিং রঙিন) মাছির শরীর দিয়ে গাঁথা একটি পঙক্তিও ঢোকে না। কোনো পাঠ থেকে। দুপুরে মা অলস নিদ্রায় বিছানা নিলে সে ছবি আঁকার খাতা খোলে। রঙ-তুলি-রাবার-পেনসিল নিয়ে। নিজ হাতে আঁকা পুরনো ছবি গুলো দ্যাখে পাতা উলটে। একটার পর একটা। ঘাছ-পাখি-ফুল-পাতা-নদি-নৌকা-মাঝি-খর-বাড়ি-মানুষ নীল-লাল সবুজ-হলুদ কত রঙে উজ্জ্বল কত ছবি। পরপর এেঁকেছে সে মনের খেয়ালে। এমনকি বাদ যায়নি বাব-মা-দাদু-র পাশে নিজের ছোট্ট ছবিও। হোক না দাদুটা আধখানা - ভাগের। তবু তো নিজের। কয়েকটা সে মার্ক করে রেখেছে। স্কুলে আন্টিদের দেখিয়ে আসবে। মা'ও বলেছে সেগুলো বাঁধাতে দেবে। তাতেই সে কত খুশি। দুচোখে উপচে পড়েছে গর্বের হাসি।
কিন্তু হঠাৎ- এখন তার তুলিতে কালো রং উঠে এল। খাতা ছেড়ে আর্টপেপারে র সাদা ক্যানভাসে কালো রঙের ছোট্ট ছোট্ট পোছলায় সে ঘন অন্ধকারটা ফুটিয়ে তুলতে লাগল। তারপর-ই রক্ত লালের বক্র লালের বক্র রৈখিক সীমায় একটা বিভৎস্য কালো মুখমন্ডল। আর দূর আকাশের নীল প্রান্ত সীমায় একটি মাত্র নক্ষত্র আর ও দূরে টিম টিম করছে। এখুনি নিভে যাবে।
শেষরাতে তার অবচেতনার গহীন স্তর থেকে এরকম ছবিটাই বুঝি উঠে উসেছিল শিশু মনের ক্যানভাসে। সেই বিভৎস্য বিষাক্ত অন্ধকারের ছবিটা কিছুতেই অঁকতে পারে না ঐন্দ্রিলা। এলোমেলে হয়ে যায় ছোট্ট মস্তিস্কে। মোটা মোটা দামনার উরু সন্ধির উপর স্কাট পরা ব্রাউন কালার চেক ইউনির্ফমের দিদিগুলোর চোখের দৃষ্টিটা সে ভালো করে দেখতেই পায়নি। সাহসে কুলায় নি। শুধুই অন্ধকারের ঘটনা প্রবাহগুলোই ফোট্ট স্মৃতিতে পিঞ্জরাবদ্ধ হয়ে আছে। তারই দীনতম প্রকাশ বুঝি ছবিটা। কোন মতে সাঙ্গ হতেই সে উদাসশূন্যচোখে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। বিছানায় মায়ের পাশ ফেরার শব্দ হতেই চকিতে দ্রুত ব্যস্ততায় সে উঠে গিয়ে নিজের বিছানার তলায় লুকিয়ে রাখল সেটা।
তবু কোন মতে পরেরদিন সপ্তাহের প্রথমদিন সোমবারটা স্কুল যায়। বাবা-মা-ট কথা ভেবেই। কিন্তু টয়লেট গুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না। মনে আসতেই চুপসে যায় ভিতরে। ওখানে বিভৎস্য অন্ধকারগুলো তার জন্য মৃত্যু ফাঁদ পেতে আছে।
গেলেই সে মরে যাবে। আর তাই ঠিক করে রেখেছিল সকাল থেকেই। জলস্পর্শ করে নি সে। খাবার সময় মা জলের গ্লাস তুলে ধরলেও সে ফিরিয়ে দিল মুখ ঘুরিয়ে। মা তবু বিরক্তি প্রকাশ করল- দেখেছিস তোর এই এক দোষ কিছুতেই জল খেতে চাস না। এতে শরীর খারাপ হয়। তবু সে ফিরিয়েই দিল। স্কুল বাস থেকে নামতেই বোতল উপুর করে সব জল ফেলে দিল রাস্তায়। তৃতীয় পিরিয়ড শেষ হতেই এক সহপাঠী তাকে সঙ্গে যাবার অনুরোধ করল। সে তৎক্ষনাত না বলেই করিডোর হতে ছুটে পালিয়ে গেল ক্লাসে। নিজের জায়গায় সেই সে বসল আর একবারও উঠল না। ছুটির আগে পর্যন্ত।
ছেটির ঘন্টা শেষে ক্লাস হতে বার হতেই সেই স্কাট পরা দিদি গুলো আবার সামনে এসে দাঁড়াল। যমদূতের মতো। দেখেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল ঐন্দ্রিলা। একপাশে তাকে আবার টেনে নিয়ে গেল। বাগানের ফুল গাছের আড়ালো - কি রে বলিস নি তো বাবা-মাকে।
- নিঃশব্দে পাংশু মুখে ঘাড় নাড়ল ঐন্দ্রিলা।
- অন্য কাউকে ? কোন অন্টিকে ?
- আবার ও এক ই ভাবে ঘার নাড়ল সে।
- হ্যাঁ মনে রাখবি, যদি বলেছিস কাউকে বিন্দু বিসর্গ, তবে তুই শেষ।
তরপরও ঐন্দ্রিলার প্রচন্ড প্রস্রাব চেপেছিল। ধরে রাখতে পারছিল না। খুব কষ্ট হচ্ছিল তলপেটে। ফুলে উঠেছিল। কুঁচকে যাচ্ছিল শরীরটা থেকে থেকে। দুচার ফোঁটা পড়েছিল প্যান্টিতেও। সমস্ত শক্তিটুকু উজার করে দিয়ে সেদিনের মতো বাড়ি ফিরেছিল কোন মতে।
(চার)
ঐন্দ্রিলাকে আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। পরের দিন সকালেই। ঘন্টাখানেকের উপর তার সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট বিনিময় করল ডাক্তার। শান্তনুকে ডেকে একবার শুধিয়ে নিল কি নামে ডাকো ? ডাক্তার শান্তনুর বন্ধু।
- ইন্দু।
তারপরে আরও কয়েকটা খুঁটি নাটি। তারপরেই বলল
- বাইরো বসো। প্রয়োজনে ডেকে নেব।
- আচ্ছা ইন্দু, তোমার কি খেতে ভালো সবচেয়ে ভালো লাগে ? নিঃশব্দ ঐন্দ্রিলা। তা দেখে প্রশ্নটা আরও সহজ করে। যেমন মিস্টির মধ্যে ? মুখ নিচু করেই ঐন্দ্রিলা একটু সরেনড়ে বসে।
- আইসক্রিম ?
দৃষ্টিটা ইষদ তোলে। করুণ চোখে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। তাতেই উৎসাহিত ডাক্তার আরো সযত্ন প্রয়াস পায়। কি ভেবে প্রসঙ্গ পাল্টায়- ইন্দু তুমি তো ছবি আঁকো, না ? গ্ছ, নদী পাহাড় এঁকেছ তো ?
চোখ তুলে আবারও আবারও ঘাড়টা কাত করে।
- আচ্ছা বলো তো নদী কেন আঁকা বাঁকা পথে এগোয় ? সোজা কেন যায় না ?
তেমনি বোবা চোখে তাকালেও প্রশ্নটা তার ভালো লাগে। মলিন মুখে চকিতে একপলক বিষ্ময় উঁকি দিয়ে চলে যায়।
- কি বলতে পারবে না ?
- ঘার অনেকটা কাত করে সম্মতি জানায়।
- বলো - তাহলে।
সে জানে ভালো করেই। কিন্তু এখন এক কথায় গুছিয়ে বলার মতো মানসিকতা তার নেই। তা দেখেই ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে জলের বোতলের ছিপি খোলে। তার সামনেই মেঝের উপরে কয়েকফোঁটা ঢেলে দেয়। অমনি বক্রপথে স্রোতটা এগিয়ে যায়। পরক্ষনেই টেবিল থেকে কাঁচ-পাথরের সুদৃশ্য পেপার ওয়েটটা স্রোতের সামনে বসিয়ে দেয়। স্রোতটা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। ঐন্দ্রিলা হেসে ফেলে। যেন কোন পরন্ত বিকেলের পাপড়ি ঝরা গোলাপের মতো - কচি পাংশু মুখখানায় লেগে থাকা সে ম্লান হাসিটুকু দেখে ভিতরে শিউরে ওঠে ডাক্তার। তবু জোড়া লাগাবার সযত্ন প্রয়াস - ভূমিতল অসমান বলেই তো ?
- হ্যাঁ... ছোট্ট শব্দটুকু অনেকটা ভিতর থেকে বেবিয়ে আসে ঐন্দ্রিলার।
- তাহলেই দেখ ইন্দু ; নদী কিন্তু থামে না। তার চলার পথে যত বাধা-বিঘ্ন উঁচু পাহাড়ও সামনে দাঁড়াক - সে ঠিক বয়ে যায় পাশ কাটিয়ে - না ?
হ্যাঁ... আর একটু জোরে উচ্চারিত হয়। বিষ্ময়ে বিস্ফারিত চোখ দুটো।
- তুমি নদীর সামনে পাহাড়ের ছবি এঁকেছ ?
- না।
- এবার তোমার বাপি সেটাই দেখাতে নিয়ে যাবে। আমি বলে দিচ্ছি... ঠিক আছে ? তোমাকে এখন কিচ্ছু পড়াশোনা করতে হবে না। তুমি শুধু জীবন্ত ছবি দেখবে আর আঁকবে।
- উূঁ... সামনেই পরীক্ষা ; দৃষ্টিটা ইষৎ কুঁচকে সে দরজায় চোখ ফেরায়। ওখানেই পর্দার পিছনে বসে আছে শান্তনু। শোনো - ওকে নদী আর পাহারের ছবি দেখিয়ে আনবে তো।
- হ্যাঁ নিয়ে যাবো... সামনেই পুজোর ছুটিতে। পরীক্ষার পরই।
- ঐন্দ্রিলা দৃষ্টি নামায়। মুখ নিচু করে আবার।
- আচ্ছা ইন্দু তুমি সূর্যের আলো-ছায়ার খেলা দেখেছ ? ভূগোলের প্যাকটিক্যলে ? গোলবের সামনে বাতিস্তম্ভ জ্বেলে ?
এন্দ্রিলা আবার ও নিঃশ্চূপ।
- সূর্যের আলো যেখানেই পৌঁছায় না সেখানেই ছায়া-অন্ধকার - ঠিক তো ?
- ঘাড় নেড়েই সম্মতি জানায় সে।
তাহলেই দেখ সবখানটা যেমন আলো হয় না তেমনি অন্ধকারটাও। আসলে দুটোই পাশাপাশি থাকে। আরও ভালো করে যদি দেখ তাহলে দেখবে আলোর ভিতরেও যেমন অন্ধকার থাকে তেমনি অন্ধকারের ভিতরেও দানা দানা আলো থাকে। দেখেছ শেটা কোনো দিন ?
- ঐন্দ্রিলা দুদিকেই মাথা নাড়ায়।
- আচ্ছা দেখ - আমি সেটাও তোমাকে একবার দেখবার চেষ্টা করছি। পরক্ষনেই ডাক্তার চশমাটা খুলে নিজের চোখ দুটো বুজলেন। - যদি চোখদুটো বুজি কি দেখি ! ঘন অন্ধকার। কিন্তু দৃষ্টিটাকে যদি দুটো ভ্রূর মাঝখানে রাখি - তাহলে ? নীল-গোলাপি-লাল-বেগুনি সব উজ্জ্বল বল গুলো মালা গেঁথে অন্ধকারের মধ্যেই আলো হয়ে ওঠানামা করছে... না ?
ঐন্দ্রিলা বলে হ্যাঁ। মেডিটেশন ফর কনসেনট্রেশন।
- বাঃ ওই তো তুমি জানো দেখছি। কে শেখালো ?
- বাপি।
পাশেই বসে শান্তনুর বুকের ভিতরে কষ্টটাকে চিরে একটুকরো শুকনো হাসি তবু বেড়িয়ে আসে।
- ডাক্তার আরও উৎসাহিত হয়ে বলেন - করতে পারবে ঈন্দু...? তাহলেই দেখবে আর কোনো অন্ধকার নেই তোমার ভিতরে। একটু জোর দিলেই দেখবে সব অন্ধকারগুলো কুচিকুচি হয়ে ঝরে পড়ছে... নীচে। আর তুমি শুধুই আলোর মধ্যে... আলোর কন্যা হয়ে বিরাজ করছ সর্বত্র।
কষ্টটা হঠাৎ-ই বুকের ভিতর দলা পাকিয়ে উঠল শান্তনুর। ভিতর থেকে নিঙরে নিয়ে এলদুফোঁটা অশ্রু...। দ্রুত আঙুলে চোখ রগড়ে মুছে নিল পরক্ষণেই।
ডাক্তারের উৎসাহে ঐন্দ্রিলা মেরুদন্ড সোজা করে স্থির হয়ে বসে। বড় কাঠের চেয়ারে পা দুটো তুলে। তারপরই নিজের চোখদুটো বোজে। অল্পক্ষণের মধ্যেই দুচোখের ভ্রূর মাঝখানটা থির থির করে কাঁপতে থাকে। পরক্ষণেই মাথাঘুরে কাত হয়ে মেঝেয় পড়ার উপক্রম হয়। দ্রুত ডাক্তার তাকে ধরে ফেলে। প্রায় সংজ্ঞা হারায় ঐন্দ্রিলা। তাকে ধরে বড় শোফাটায় শুইয়ে দেওয়া হয়। ডাক্তার একটা ইনজেকশন পুশ করেন।
- আজই কোন একটা হাসপাতালে ভর্তি করে দাও। শরীরটা খুবই দুর্বল।
- তেমন বুঝলে কোন সাইকিয়টিস্ট - না থাক পরে। জানায় ডাক্তার।
বেসরকারি হাসপাতালে সেদিন-ই ভর্তি হয়ে শুরু হয় ঐন্দ্রিলার দ্বিতীয় দফার চিকিৎসা। উন্নিদ্র রাত কেটে যায় চোখের সামনে। শান্তনু শোহিনির। পরের দিন বিকেল পর্যন্ত...। উন্নতির কোন লক্ষন তো নয়ই বরং আরও অসুস্থতা লক্ষ করল তারা। ঐন্দ্রিলার।
বিকেলেই সেখান থেকে ছাড়িয়ে তারা তাকে নিয়ে গেল শহরের নামকরা সাইকিয়ট্রিস্টের কাছে। আধঘন্টার উপর পরীক্ষা নিরিক্ষা করে ডাক্তার বাবু ইনজেকশনটা লেখে দিলেন শান্তনুর হাতে। ...শেগগির নিয়ে আসুন... দেখছি কি হয়। আকাশ ভেয়ে পড়ল শান্তনুর মাথায়। এ কি ! এ টা কেন স্যার ?
- যা বলছি -শুনুন। আপনি কি ডাক্তার ? তা যখন নয় আমাকে আমার কাজ করতে দিন।
অগত্যা শান্তনু ছুটে গেল ওষুধের দোকানের দিকে। কৃষকায়া প্রায় অচৈতন্য ঘোরের মধ্যে থাকা ঐন্দ্রিলার পাশে নিঃশ্চূপ পাথরের মতো মেয়ের দিকে তাকিয়ে বসে রইল শোহিনি। ঈশ্বরকে ডাকতেও ভূলে গেছে সে। শুধু কপোলে বাহিত দুচোখের অশ্রু মুছেযায় আঁচলে ঘন ঘন।
ইনজেকশনটা পুশ হতেই ছোট্ট শরীরটা বেঁকো চূড়ে যায় ঐন্দ্রিলার। বিস্ফারিত দুচোখের বিভৎস্য দৃষ্টিটা কপাল চিরে একবার উপরে উঠে যায়। সেদিকে তাকিয়েই ভিতরটা ডুকরে ওঠে শোহিনির। দ্রুত স্নেহের করতলে চাপা দেয় কন্যার দুচোখের পাতায়।
এরপর ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে বাড়ি ফেরে ওরা। সন্ধ্যে থেকেই ছাদে চিলেকোঠার মাথায় কাল পেঁচার কর্কশ রুক্ষ স্বরটা চিরে দেয় আকাশ-বাতাস। সেই স্বর শুনে ভিতরে আঁতকে ওঠে শোহিনি। ঠায় বসে থাকে কন্যার শিয়রে। অলিন্দে থমকে থাকা আরেকটা উন্নিদ্র অভিশপ্ত রাত তবু কাটে।
দেখেশুনে সাতসকালেই মেয়েকে নিয়ে আবারও গাড়িতে ওঠে শান্তনু-শোহিনি। গন্তব্য সোজা এ্যাপেলো হাসপাতাল। শহরের অন্যত্তম নামকরা চিকিৎসালয়।
ঘন্টাদুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসে তারা।ফিরতি পথে পাড়ার চাইল্ড স্পেশালিস্ট বন্ধু ডাক্তার তাদের দেখা মাত্রই গাড়ি থামায়। শশব্যস্ত হয়ে নেমে এগিয়ে যায়। উৎকণ্ঠার নরম সুরে শুধায় শান্তনুকে -এখন ইন্দু কেমন আছে ?
প্রচন্ড ঝড়ে সহসা সশব্দ বৃক্ষপতনের মতো কান্নায় ভেঙে আছড়ে পড়ে শান্তনু। রাজপথের উপর...। নেই ডাক্তার -চলে গেছে আমার ইন্দু অন্ধকারেই।
গঙ্গাফরিংটা আজও এসেছে ছাদের কার্নিশে ছোট্ট ছোট্ট ফুলবাগানে। চলে গেছে ঐন্দ্রিলা অন্ধকারে, মিলিয়ে গেছে দূর আকাশে, তার সেই আঁকা ছবির ঘনান্ধকারেই। পড়ে রয়েছে বই-খাতা-পেন টেবিল জুড়ে ...রঙ তুলি রবার পেন্সিল বিছানা জুড়ে। যে অন্ধকার তার মনে স্থায়ী বাসা বেঁধেছিল তাকে ভেদ করতে আর পারে নি সে, ভেদ করার সুয়োগ পায়নি শান্তনুও। স্কুলে গিয়ে। লোকাল থানায় পরের দিন একটা অভিযোগ করেছিল শুধু।
পরের দিন থেকেই টি.ভি-র সমস্ত ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার চ্যানেলে খবরটা ঘুরে ফিরে প্রকাশ হতে লাগল। সমগ্র দেশবাসী অবাক বিষ্ময়ে শোকার্ত ্যৃদয়ে প্রত্যক্ষ করল -এই প্রথম কোন স্কুলে র্যগিং-র শিকার হওয়া ছোট্ট ঐন্দ্রিলার রহস্যময় মরণটাকে।
ক্ষোভ-অভিমানে উত্তেজিত জনতা-অভিভাবক মিলে ঐন্দ্রিলার স্কুল চত্বরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করল পরের দিনই। সারাদিনের সমাবেশে উন্মত্ত জনতার একাযশ লক্ষাধিক টাকার সম্পত্তি ভাঙচূর করল...। দাঁড়িয়ে অবাক বিষ্ময়ে দেখল রাজ্যপুলিশ প্রশাসন। জনতার চাপে অধ্যক্ষা পদত্যাগপত্র লিখে দিতে বাধ্য হল। তারপরও হল এ্যারেস্ট। সবকিছু কভারেজ করল মিডুয়ার দক্ষ ক্যামেরা। মৃত্যুটাকে খোঁজার পালাও শুরু হল - সিলমোহরে।
কিন্তু যে অন্ধকার ঐন্দ্রিলার ছোট্ট মনের সব অলোকে একটু একটু করে মুছে দিয়ে বহন করে এনেছিল অকাল মৃত্যুর অমোঘ বার্তা... তা কি আবিস্কৃত হবে কোনো দিন ? যদিবা তা হয়- তবে তা নিরসন করবে কে। উপছে পড়া অভিশপ্তময় সমৃধির দুর্গন্ধী নালা বাহিত পচা গলনটার পথ রুদ্ধ করবে কে ? দূর অন্ধকার আকাশে একটুকরো রূপোলী আলোর মতোই প্রশ্নটা এখন তোলপাড়িয়ে ওঠে... প্রাণপ্রিয় একমাত্র আত্মজা হারা শোকস্তব্ধ শান্তনুর সঙ্গে লক্ষ লক্ষ ঐন্দ্রিলার বাবার বুকে ?
ছোট্ট পল্লবে গঙ্গাফরিংটা থিরথির করে কাঁপতে থাকে... ঐন্দ্রিলা তার কথা রেখেছে। এখন তার চিনে নেওয়ার পালা সঙ্গীকে !
No comments:
Post a Comment