ছোটগল্প_রক্তপায়ী
রক্তপায়ী
ধ্রূবপালি শুদ্ধতা
(এক)
মৃত্যুভয়টা ইদানিং তাড়া করে বেড়াচ্ছিল দিলদারকে। রাতে বিছানায় ঘুমনাশা। বিশেষ করে মধ্যরাতের পর। যখন দুরন্ত বাইক গুলোর বিকট কর্কশ টানা আওয়াজ গুলো ঘুমন্ত রাতের স্তব্ধতাকে চিরে ফালা ফালা করে তার সদর দিয়ে চলে যায়। গাঁয়ের ভিতর দিয়ে। একে বেঁকে...। তখনি সে তড়াক করে বিছানায় লাফিয়ে বসে। খালি গায়ে। ঘামতে থাকে কলকলিয়ে। শুরু হয়ে যায় বুকের ভিতর ধকধকানি খেলাটা। ছোট করে কাটা মাথার চুলগুলো ঘামে ভিজে গিয়েও ঠারো হয়ে ওঠে।
যদি ওরা দরজা ভাঙে কিংবা টপকে বাড়ি ঢোকে ! সে কি সামনে মুখো-মুখি দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করবে...!
অসম্ভব ! কি নেই ওদের হাতে। ভোঁজালি, বর্শা, ক্রিচ, ধারালো-ছুঁরি, পিস্তল সব। আর সংখ্যায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন কম করে। প্রত্যেক বাইকে দু তিন জন..। এই সব মারাত্মক মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে রাত ভর গ্রাম গুলো টহল মেরে যাচ্ছে।
যদিও তেমন কিছু ঘটে না। ঘন্টাদুয়েক পর আবার আওয়াজ গুলো ফিরে এলেও শেষ পর্যন্ত মিলিয়েই যায় রাত শেষের অন্ধকারে। শেষ রাতটুকুতে গ্রামটা ফিরে আসে নিজের জায়গায়।
চৌত্রিশ দিলদার স্বভাবতই দিশেহারা। কদিন ধরে। গত দশবছর সে পার্টিটা করে আসছে। নাওয়া খাওয়া একরকম শিকেয় তুলে। শুরুটা হয়েছিল সেই চব্বিশ বছর বয়সে। ২০০৮-এ। এমনি পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাস কয়েক আগে। বাবার-ই সহকর্মী গনু সিংহের হাত ধরে এসেছিল প্রথম। গঞ্জের ময়দানে। বিরোধী দলের সমাবেশে। শহর থেকে আসা একঝাঁক নেতা বসেছির মঞ্চের উপর। আগুন খেকো বক্তিতা শুনে সে যাই বুঝুক.. গনু বুঝিয়েছিল শেষে এই পার্টিটাই আসছে।
দলের ভিতরকার কতা। উপর তলার। বলা কওয়া শুনেছি। বলে দিলুম মিলিয়ে নিস।
গনু তখন শাসকদলেই ছিল। শেষটায় আর তেমন সুবিধে হচ্ছিল না। কড়াকড়ি..। উপর তলার চাপ। শুদ্ধিকরণ.. ড্যমেজ কন্ট্রোল এ সব কি না লেগেই ছিল। সাসপেন্ড করে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছিল... ছোট বড় কমরেডদের। তলায় তলায়..। তবে আর কি করতে পড়ে থাকা। আবর্জনা স্তুপের মতো। অপমান গালিগালাজ সব মুখ বুজে সয়ে। অঞ্চল সেক্রেটারি হয়েও বেড়িয়ে এসেছিল সেদিন। সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে। তাদের অর্নত্তম ছিল দিলদারের বাপটাও। তৌহিক।
বাপের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল দিলদারও। গনুর ছায়া সঙ্গী হয়ে। ক্রমে পার্টি কর্মী হয়ে ওঠে।
অঞ্চলের এমন কোনো পার্টি পোগ্রাম নেই, যেখানে দিলদার নেই। তাছাড়া রাজ্যস্তরের মিটিং মিছিলেও গনুর সাথে পা মেলানোয় ব্যাতিক্রম ছিল না তার। এমনকি গনু ছাড়াও। গাঁ ভিন গাঁয়ের সমর্থক অসমর্থকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বসে থেকে সঙ্গে করে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা ভারা করা বাসে তুলে শহরের সমাবেশে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথেই পালন করে এসেছে।
পাড়ায় উঠতি কয়েকটা চ্যাংড়া চেলাও তৈরি করে নিয়েছে। ডাইনে-বাঁয়ে। রাত বিরেতে অনেক সময় বাইকে ফিরতে হয়। সাবির, নুর, জলুরা তখন সঙ্গেই থাকে এগু পিছু করে।
সাবির বলে পঞ্চায়েত ভোটটা দুম করে চলে এল। না কি বল দিলু ভাই।
বুঝচিস না ক্যানে, আমাদের দলটা সরকারে আছে, তাল বুঝেই তড়িঘড়ি করে নিতে চাইচে।
এবার কিন্তু তোমায় দাঁড়াতেই হবে। সদস্যটা না হলে কদ্দিন আর হ্যাংলামো করবে ? যাই বলো সইয়ের দাম আলাদা।
টিকিট দেবে ? এ অঞ্চলটা দেবু মাস্টারের।
দেবে না মানে ?
গনু ভাই তো শত্রূদল থেকে এয়েচে না, তাই জোর খাটাতে পারে না।
ক্যানে একেই তো অঞ্চল সভাপতি করেচে।
তা করেচে, ওর পকেট গুলোও তো পেতে হবে।
দেবু মাস্টার কে ধরো.., যদি না দেয় তো চলো বড়ফুলে।
লুফে নেবে।
রাজুদা দেখা হলেই বলে।
কি ?
দিলুটাকে নিয়ে আয় ; সমিতির আসন পাক্কা।
চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় দিলদার বলচিস ?
দিল দার মুখে একথা বললেও পরিস্থিতি বুঝে ভিতরে ভিতরে সেও একপা তুলে নিয়েছে.., রাজুর সঙ্গে তারও ফোনে কথা হয়েছে.., সেটা তখনো টের পায়নি অনুগামীরা।
এখন তাদের মুখে সে কথা শুনে খানিকটা আশ্বস্ত হয়।
(দুই)
রাত্রি বারোটা। নোয়াপাড়া কবর স্থানের পাশে বেল তলায় একে একে জড়ো হয় বাইকগুলো। প্রত্যেকটা বাইকে দু তিন জন করে আরোহী। কয়েকজনের কাঁধে ঝুলি। জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম এই নোয়াপাড়া। নটা পাড়া নিয়ে সম্পূর্ণ মমুসলিম অধ্যুষিত বড় গ্রাম। তারি পাশাপাশি আরও দু-তিনটি পাতলা বসতি। উপগ্রাম। হোদলা-আহিরি-টুঁটিচাপা। হোদলায় সবই গোয়ালা। কায়স্থ পরিবার। আহিরি ও টুঁটিচাপায় অন্যান্য উপজাতির বাস। পাকা সড়কের দুধারে। শোনা যায় একটা সময় ছিল যখন ঠেঙারে দস্যুদের মুক্তাঞ্চল ছিল এই এলাকা। চওড়া পাকা সড়ক চলে গেছে ব্লক শহর থেকে জেলা শহরে। তাকেই কেন্দ্র করে বড় বড় গ্রাম গুলির মোড়ে গজিয়ে উঠেছে স্থানীয় বাজার। গ্রামের ভিতর থেকে উঠে এসেছে অনেক উঠতি পরিবার। রাস্তার ধার বরাবর। দ্বিতল ত্রিতল পাকা বাড়ি। দোকান বসতি। তারই সাথে সরকারি ভবন। স্কুল, পঞ্চায়েত, সমবায় ব্যাঙ্ক, পোষ্ট অফিস ইত্যাদি। কাজেই পুরনো বিন্যাস গেছে পালটে। উন্নয়নের ধাক্কায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। নোয়াপাড়া গ্রামপঞ্চায়েত অন্ত্রর্ভুক্ত আঠারো কুড়িটি গ্রাম। সতেরটি বুথ। ঘুমের চাদরে যখম চাপা পড়ে যায় রাতের অন্ধকারে.. তখন জেগে ওঠে এই চল্লিশ পঞ্চাশ জন যুবক। যারা স্বঘোষিত ভার নিয়েছে অঞ্চল দেখভালের। তলোয়ার, পিস্তল, বোম-বারুদ ইত্যাদি সব ভয়ঙ্কর মারনাস্ত্র নিয়ে যারা রাত ভর অঞ্চলটায় টহল দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছে।
প্রায় সব গ্রাম থেকেই নূন্যতম একটা বাইক ও দুজন করে আরোহী এসে জমা হয়। মিনিট পনেরর মধ্যেই। এই দুজনই শেষ পর্যন্ত সেই গ্রমের শেষ কথা। ভালো মন্দের ভাগ্যবিধাতা। অদৃশ্য.. অলিখিত। কেননা পরিবার গুলোর খুঁটিনাটি সমস্ত তথ্য তাদের নখদর্পনে। কি খায়, কোথায় যায়, কি কি বলে.. কোনো কিছুই তাদের অজানা থাকে না।
বাইরের অঞ্চল থেকে আসে দু-চার জন। বাইক থেকে নেমে দলটা বৃত্তাকারে জড়ো হয় বেলতলায়। নীচু স্বরে বিনিময় হয় কিছুক্ষন। প্রতিদিনকার মতো ফিরোজ আজও একটা রুটম্যাপ শোনায় সকলকে। নোয়াপাড়া গ্রামের ভিতর দিয়েই চার কি.মি. লাল মোরামেররাস্তা চলে গেছে পশ্চিমে। পাশের কুলটি গ্রামে ঢুকে যুক্ত হয়েছে অন্য একটি স্টেশন গামী পাকা সড়কে। কুলটিতে ঢোকবার মুখেই দিলদারের বাড়ি।
দলটির নেতৃত্বে দলের অঞ্চলিক সভাপতি ফিরোজ। ফিরোজ সমিতির সহ সভাপতি দেবু মাস্টারের কাছের লোক। অনুগামী। তাই অঞ্চল সভাপতি গনু সিংহকে সে পাত্তাই দেয় না। কেননা মাদার পার্টির অঞ্চল সভাপতির পদটা তারই প্রাপ্য মনে করে ফিরোজ। দেবু মাস্টার প্রবোধ দেয়- নির্বাচনটা পার কর দেখছি।
দিলদারের হাবভাব ভলো না সে খবর ছিল ফিরোজের কাছে। সন্দেহের তারিকায় সে উঠে এসেছিল তলায় তলায়। তার সে মতি গতির খবর কমাস অগেই সে পৌঁছে দিয়েছিল উপর তলায়। দেবু মাস্টারের কাছে। দেবু মাস্টার বলেছিল- ওয়াচে রাখ। দলের অলিখিত নিয়ম এই- চান্স না পেলে সাইড লাইনের ধারে রিজার্ভ বেঞ্চেও বসে থাকবে তবু বিরোধী দলে নাম লিখিয়ে খেলা চলবে না- সেটা কি জানিস না ?
তাই দিলদার ওয়াচেই ছিল এতদিন- ওয়েট এন্ড ওয়াচ নীতি মেনে।
হঠাৎই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরকার ভোটের দিনক্ষণ ঘোষনা করে দিল।
আগামী কালই মনোনয়ন পেশের শেষ দিন।
ইতিমধ্যেই সপ্তাহ খানেক ধরে এ অঞ্চলে বিরোধী দলের যে কটা মনোনয়ন জমা পড়েছে- সবই ফিরোজের হাতে গোনা। সে হিসেব করে বলে দেয়- পাঁচটা। সমিতির একটা নিয়ে। তার ছায়া সঙ্গী কালু বলে ভাই শেষ দিনে বাকি গুলো জমা দেবে।
সে তো দুঃস্বপ্ন, অই পাঁচটাকেই প্রত্যাহার করাবো তুই দেখে নে। আজ সে রকমই কাজ আচে। কেউ যেন এদিক ওদিক করবি না। আমি যেভাবে নির্দেশ দেব তার যেন এতটুকু নড়চড় না হয়।
ঠিক আচে, সশব্দে সমবেত উচ্চারণ করে সকলেই সম্মতি জানায়।
আর দিলুটার কি করবে গুরু- শেষ মুহূর্তে কালু শুধোয়।
এখনো তো নামটা লেখায় নি- লেখাক তার পর দেকচি।
কিন্তু ওই তো সাহস জুগিয়েছে বেনুদের।
চল... দেকচি।
বারোটা পনেরয় বাইক গুলো রওনা দেয়।
(তিন)
শেষ পর্যন্ত সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছুঁড়ে ফেলে দিলদার। যখন দেখল দল বিশেষতঃ দেবু মাস্টারের দল বল তাকে কোনো টিকিটই দেবে না।
এই কয় দিন সে গনু সিংহের পিছু ছাড়েনি। সারাটা দিন দলীয় কার্যালয় থেকে ব্লক অফিস- গাঁ ভিন গাঁয়ের দলীয় আঞ্চলিক দলীয় কার্যালয় ঘুরে ঘুরে রাতে বাড়ি ফিরেছে।
গনু সিংহ তাকে জানিয়ে দিল কোনো আশাই তো দেখছি না রে। সতেরটা আসনে ইতিমধ্যেই কুড়িটা জমা পড়েছে। কাল আরও দুটো পড়বে। ফুলগাম ও রাইপুরের।
এম.এল.এ কে পাঁচটা দিয়ে বাকি বারোটা ওরা ভাগ করে নিয়েছে। চার জনে। সভাপতির স্বামী হায়াদার আলি আরও একটা চেয়েছিল, পায়নি।
তোমাকে ?
না, একটাও না। সমিতির সিটটা দিয়েছে শুধু। তাও হায়দার জোর করাতে।
দিলদার অমনি গনুকে জানিয়ে দেয়- তাহলে আমি ছাড়লুম।
গনুর অজনা ছিল না। তবু হাঁ করে বিস্ময়ে তাকায় একপলক। ভিতরে আটকে থাকা একখন্ড বাতাস হুম শব্দে বেড়িয়ে আসে। বলে ওরা কি তোকে টিকিট দেবে ?
হুঁ... সমিতির। কালই জমা দেব।
তাহলে বাড়িতে থাকিস না রাতে... কারণ শুধোস না।
দৃষ্টি বিস্ফারিত করে তাকায় দিলদার। বলে বুঝেছি।
পারলে ও-কটাকেও সরে যেতে বলিস -পুনরায় জানায় গনু।
মধ্যরাত পার হতেই কেঁপে কেঁপে ওঠে গোটা গ্রাম। বিস্ফোরণের ভয়ঙ্কর শব্দে। কাঁচের বাসনের মতো ভেঙে খান খান হয়ে যায় নিশুতি রাতের স্তব্ধতা। কোলের শিশু বিছানায় অকষ্মাৎ জেগে উঠেই কঁকিয়ে ওঠে আর্তস্বরে। ঘরবন্দি মানুষ গুলো আঁতকে ওঠে ঘুমের থেকে। বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালাতেও সাহসে কুলায় না। কেউ কেউ ত্রস্ত পদে কোন রকমে জানালার খোলা উপর পাট বন্ধ করে নিঃশব্দে মশারিতে ঢোকে।
এর পর অনাচে কানাচে যে টুকুও বা অবশিষ্ট থাকে নিমেষে সব গ্রাস করে সন্ত্রাস। ভেসে আসে আগুন... আগুন... বলে চাপা শব্দ। সঙ্গে বয়ে আনে পোড়া গন্ধ। বেনু গোপালের খামারেই পর পর বিস্ফোরণ গুলো ঘটানো হয়। বড় পালুইয়ে আগুন ধরে দাউ দাউ করে ঠারো জ্বলে যায়। সঙ্গে পাশেই থাকা জন মুনিশের চালা ঘরটাও। আর কদিন পরই বাইরে থেকে তাদের আসার কথা। বোরো ধানে পাক ধরেছে। গোলা জাত করতে। বেনু গোপাল বাড়ি ছিল না। থাকলে হয়তো বেরিয়ে আসত...। আর তখনি আরও দুটো একটা বোমার আঘাতে তার শরীরটাও ছত্রকার হতো।
পরিস্থিতি অনুমান করেই সে সটকেছে। দিলদারদের সঙ্গে করে। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসাতেই দিলদার এসেছিল তার কাছে। চুপিসারে। গনু সিংহের সতর্ক বাণী শোনায়। তারপরই একপ্রস্থ আলোচনা হয়। অন্যান্যদের ফোনে ডেকে এনে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই পরিকল্পনাটা তৈরি করে ফেলে তারা। পাশের জেলার হীরাপুরেই পালাবে তারা। জেলাস্তরের নেতা সহ সভাপতি রাজুদা কে ফোনে ধরে জানানো হয় সব কথা। দিলদারের অন্যান্য সাঙ্গ-পাঙ্গ দের খবরটা জানানো হয়।
রাজুর নির্দেশ মতোই রাত দশটার মধ্যেই হীরাপুর পার্টি অফিসে উপস্থিত হয় তারা। আর সেখানেই অরেক প্রস্থ আলোচনায় হীরাপুর ও নবগ্রামের কোন কোন পার্টি কর্মির বাড়িতে তারা রাত কাটাবে তা ঠিক হয়।
পরের দিন সকাল নটার মধ্যেই সকলকে জুটিয়ে এনে পার্টি অফিসে উপস্থিত হবার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সকাল হতেই বেনু গোপালরা বাড়ির ফোনে সব খবর শুনে জ্বলতে থাকে ভিতরে।
(চার)
সকালে নোয়াপাড়া বাজারের চা বেঞ্চিতে নিচু স্বরে বিনিময় চলে।
পৌঢ় দিবাকর ঘোষ রিটায়ার্ড প্রাইমারি শিক্ষক। বলে- মন্টূ ভাই এসব কি হচ্ছে !
মোন্টূ মোল্লা সম্পন্ন চাষি। বলে সেই তো, এসব তো হবার কথা ছিল না। এসব হচ্ছিল বলেই তো বা সব পাল্টানো। একন তো দেকচি টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাস।
পাশেই ছিল সামু। ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে বলে- তবু ভালো। ওদের অত্যচার সব ভূলে গেছ কি না। পুকুরে মাছ হতে দিয়েচে, গোলায় ধান তুলতে পেরেচো- এ্যাঁ...।
ওদের চোখে মুখে ছিল হিংসা.. নিঃশ্বাসে ছিল বিষ। কম রক্তপায়ী ছিল না কি ওরা।
সেই ওরাই তো এয়েছে ঘুরে। বকলমে। ওদের ছায়াই তো ঘিরে রয়েচে সব খানটায় দ্যাকো তাকিয়ে।
সকাল সাড়ে নটার মধ্যেই হীরাপুর বাজারের পার্টি অফিসে একে একে জড়ো হয়ে যায় সব। তির-ধনুক তলোয়ার যে যেমন পারে সঙ্গে নিয়ে আসে। আশপাশের দশবারোটি গ্রামের সমর্থক থেকে পার্টি কর্মী। সমবেত দের ছোট বড় দুটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। সশস্ত্র মিছিল করে জনা পঞ্চাশের ছোট ভাগটা যাবে পাশের জেলার বি.ডি.ও অফিসে। দিলদার বেনু গোপালদের সঙ্গে করে। শেষ দিনে মনোনয়ন পেশ করতে।
আর বাকি দেড় দুশ নিজেদের হীরাপুর বি.ডি,ও. অফিসে। ওরা যতই ভয় দেখাক, আক্রমন করুক একটা অসনেও ওয়াক ওভার দেওয়া হবে না। উপর তলার কড়া নির্দেশ। পালটা আক্রমনের জন্য সবাই যেন তৈরী থাকে। জেলার নেতা দশ মিনিটের বক্তিতায় উজ্জীবিত করে দলটাকে।
আঞ্চলিক মন্ডলের সভাপতি কিশোরকে বলে দিলদার-- ভাই আমাদের দিকে আর একটু বাড়িয়ে দিলে ভালো হত। তোমাদের এদিকটায় তো পরিস্থিতি তেমন না। আমাদের আঞ্চলটায় অবস্থা খুবই ভয়ঙ্কর.. কি বলব। একটু জোর পেতাম আর কি। আর আমি তো টার্গেট হয়ে গেছি। বেনুগোপাল সায় দেয় দিলদারকে। পরিস্থিতি সবখানটাতেই এক। এই ভালো তো নিমিষে ভয়ঙ্কর। তবু বলছ যখন দেকছি কি করা যায়। তোমাদের ওখানটাতে বিশ-পঞ্চাশ জুটবে না ?
বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাতের অন্ধকারে শাসিয়ে আসছে যে। তারপরও বোম মারছে। রাস্তা ঘাট বাজারে একা এলেই পিটোচ্ছে। কাল রাতের খবর শুনলে তো। বাড়িতে থাকলে খুন হয়ে যেতুম।
তালডাঙ্গা থেকে আসা কুড়ি-পঁচিশ জনের সশস্ত্র আদিবাসী দলটাকে যুক্ত করে দেয় কিশোর দিলদারদের সঙ্গে। যাদের গোটা পঞ্চাশ পরিবার চওড়া পাকা সড়কের দুধারে বিক্ষিপ্ত হয়ে কুঁড়ে ঘরে বাস করে। কিছু পরিবার পাশের জেলারও অন্ত্রভুক্ত। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের স্পর্শ পেলেও তির-ধনুক-বল্লম-ভোঁজালি যাদের শিকার ও একই সঙ্গে আত্মরক্ষার ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র বিশেষ। যদিও আজ আর তেমন কাজে লাগে না।
যাদের ভিতর দু জনকে পার্শ্ববর্তী দুজেলার দুই পঞ্চায়েতের সদস্য পদে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। শিবু সরেন আর মুংলী মুরমু। মুংলী আর তার স্বামীকে রেখে বাকি দলটা চলে যায় ও দিকেই।
(পাঁচ)
ভালকো পঞ্চায়েত সমিতির সাত আট কি.মি. দূরে মথুরাপুর বাজার। তারই উপকন্ঠে এই তেমাথার মোড়। রাস্তার দুধার বরাবর পাকা ঘরের বসতি। দক্ষিন-পশ্চিম কোনে হীরাপুর থেকে পাকা সড়কটা এসে এই তেমাথায় মিশেছে। সোজা উত্তরে ভালকো পঞ্চায়েত সমিতির বি.ডি.ও. অফিস। নোয়াপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত যার অন্ত্রভূক্ত। বেলা দশটা। প্রায় শ-খানেক মানুষের মিছিলটা এগিয়ে আসতে দেখা যায়। অস্ত্রের সঙ্গেই থাকে ফেস্টূন ব্যানার। আর উচ্চারিত স্লোগান। দূর হটো... দূর হটো...। নিপাত যাক... নিপাত যাক...।
চওড়া তেমাথায় উঠে মিছিলটা বাঁ দিকে বাঁক নিতেই বিস্ফোরণ...। পর পর...। একটা-দুটো-তিনটে-চারটে...। ভয়ঙ্কর শব্দ দানবের হুংকারে কেঁপে কেঁপে ওঠে গোটা বাজার। বাজার সংলগ্ন বসতির ভিতর দু-চারটে সদর হয়তো বা হাট করে খোলা ছিল.., সশব্দে খিল আাঁটাতে মালুম হয়। আমনি দোকানের ঝাঁপ পড়ে আরও শব্দে। স্টিলের গেট-গ্রিল-সাটার ফেলার শব্দ। ভিতর থেকেই। ঘর বন্দি হয়ে যায় গোটা বাজার। ফুটপাতের টোং-এ হালকা যারা আধবন্ধ রেখেই যে ধারে পারে চম্পট দেয়। যেন সূতোয় ঝোলা জীবন... নিস্পন্দ হতে কতক্ষণ।
আগুন ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ যখন কয়েক মুহূর্তের জন্য সব আত্মসাৎ করে নেয়... মিছিল ছত্রাকার হয়ে যায়। কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়ার ভিতর ঝাপসা ছায়ামূর্তি গুলো এলো মেলো যে যেদিকে পারে দৌড় দেয়। সকালের রৌদ্রজ্জ্বল মাখা বসতি... রাস্তা বাজার নিমেষে বধ্য ভূমিতে পরিণত হয়।
মিছিলের অগ্রভাগে ছিল দিলদার। বড়ফুলের পতাকা হাতে। ছিটকে চলে আসে ডান দিকটায়। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা জোরালো শব্দ বন্ধনী কানে যায় তার।
অইতো দিলদার.. শালা বেইমানটা দে শেষ করে...
অমনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গর্জে ওঠে পিস্তল। সশব্দে...।
ছুঁচলো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ গুলো দুরন্ত বেগে তার বুক পাঁজরের ভিতর ঢুকে ঝাঁঝরা করে দেয় নিমেষে। রক্তাক্ত দেহে সে লুটিয়ে পড়ে রাস্তার উপর।
নিমেষে শুন শান গোটা বাজার চত্ত্বর। অকুস্থল থেকে বেশ খানিকটা দূরে জেগে থাকে অবিরাম শুধু কুকুরের চিৎকার। মুখগুলো আকাশ পানে তুলে লম্বাটানা আর্তস্বরে কার কাছে কোন বার্তা পাঠায়... এরাই জানে।
মানুষের আশে পাশে সারা জীবন থেকে তাদের অন্নে প্রতিপালিত হয়েও মানুষ গুলো বুঝি দুর্বোধ্য থেকে যায় সারাটা জীবন।
সে সব শব্দ চিরে উজ্জল দিনের মধ্যভাগে শশ্মানের চেহারা নেওয়া জনবহুল বাজারের রাজপথে লাশ কুড়োতে আসে পুলিশ। হাতের সঙ্গে মুখেও কুলুপ আাঁটা।
খানিক পরে রাস্তার কুকুর গুলো ফিরে আসে অকুস্থলে। কালো পিচের উপর পোষাক ছাপিয়ে পড়া দিলদারের বক্ষ নির্গত চাপ চাপ তাজা রক্ত...। জমাট বেঁধে আছে। মুনিব নামক মানুষের নোনতা রক্ত। স্বাদ গ্রহন করে তার। চেটে খায় গনতন্ত্র...। বহু বছরের বহু মানুষের রক্তাক্ত সংগ্রামের ফসল।
বাজারের প্রান্তে ভাটি খানায় পেট ভর্তি গিলে ছামু মাতালটা পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। কয়েগ মুহূর্ত অপলক তাকিয়ে থাকে। সে দৃশ্য পানে। কি ঘটে গেছে... বাকি পৃথিবীতে নিরন্তর কি ঘটে যাচ্ছে...। সে সবের কোনো খোঁজের প্রয়োজন পড়ে না তার। বিড়বিড় করে আপন মনে কি বলে সেই জানে। পাশেই পড়ে থাকা এক টুকরো পাথর খন্ড তুলে নেয় হাতে। কুকুর গুলোর দিকে ছুঁড়ে মারে। আর ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে বলে-- আচ্চা পিশাচ... রক্তপায়ী তোরা।
(ছয়)
ঘরে ঘরে টি.ভি.-র পর্দায় শুরু হয় সম্প্রচার। সব কটা বংলা খবরের চ্যানেলেই। টি.ভি. সাংবাদিক ঘটনা স্থলের ছবি তুলে ধরে। কোটি কোটি দর্শকদের উদ্দেশ্যে। কে এই দিলদার ? রক্তাক্ত রাজপথে উবুড় হয়ে পড়ে মৃত্যু শয্যায়।
ঠায় ঠিকানা বহন করে সাংবাদিক যায় নোয়াপাড়া অঞ্চলে তার বাড়ি।
টি.ভি.-র দৌলতে সচিত্র খবর ততক্ষণে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। দৃশ্য দেখে কেউ কেউ যেমন শিউরে উঠেছে, আবার অনেকে বলে এ আর এমন কি ! এটাই তে বাংলার রাজনৈতিক কালচার... অনেক দিন ধরে।
দিলদারের বাবা তৌহিক সেই ৭৭ সালে এমনি রক্তাক্ত দিনে বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ছিল। তার পর বেরিয়ে আসে সেও এক দশক। আগাগোড়া রাজনীতিতে মোড়া তৌহিক সাংবাদিক দের প্রশ্নের উত্তরে জানায় ওতো এই পার্টিটা ছেড়ে দিয়েছিল। অই পার্টিটাই করত।
কত দিন ?
অনেক দিন।
সময়ের বিচারে গুরুত্ব আরোপ করার কোন প্রয়োজনীয়তা তার মনে হয়েছিল কে জানে। অথবা অপ্রকাশ্য ভিতরের সত্যিটা তো বাবা-মায়েরই জানার কথা।
বিরোধী দলের রাজ্য সভাপতি জানায়-- দিলদার তাদের দলেরই সহকর্মী ছিল। গত তিন বছর ধরে। শাসক দলের গুন্ডারাই তাকে খুন করেছে।
এ পর্যন্ত এক-রকম ঠিক ছিল। কিন্তু অন্য রকম অরেকটা ঠিক বেরিয়ে আসতে কয়েক ঘন্টা পার হল। যখন শাসক দলের জেলা সভাপতির পাশে বসে দিলদারের সেই বাবাই জানাল-- দিলু এই পার্টিটাই করত। দশ বছর ধরে। ভূল সংশোধন করতে জানায় তখন মাথার ঠিক ছিল না।
খবর শুনে নোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যলয়ে দিলদারের এক মাস্টার মশাই অমিয় বাবু তার স্ত্রীকে বলে- মাথার ঠিক না থাকাটাই স্বাভাবিক কিন্তু যা অস্বাভাবিক তা হল পৃথিবীর কোনো শোকের সঙ্গেই যার তুলনা চলে না... সেই পুত্র শোকও আজকের গনতন্ত্রে বিপন্নতার শিকার। অমিয় বাবুর একমাত্র ছেলেও পেশায় শিক্ষক। বলে বাবা জানোনা বুঝি আজকের গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একটা লাসের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা বেআব্রূ, নির্লজ্জ গণতন্ত্রের লজ্জাভরণতো ওই লাসটাই। সেটা শেষ পর্যন্ত যাদের অধিকারে থাকে... তাদের হাতেই যে অসল গণতন্ত্রটা সুরক্ষিত থাকতে পারে...। এই বিশ্বাস জনগণের মনে গেঁথে দিতে পারলেই কাজ সারা। কাজেই এমন লাসের জোগান সব দলের কাছেই মহামূল্য।
মিছিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া বেনু গোপালরা বাড়ি ফেরেনি। কে কোথায় খোঁজ খবর নেওয়ার অবকাশ থাকে না। ফোনের সুইচ অফ। পরের দিন সন্ধ্যায় খবরটা শোনে বেনুগোপাল। বিশুসরেন সহ তাদের পাঁচ জন প্রার্থীই মনোনয়ন জমা দিয়েছে। তবে, তাদের দলে না, শাসক দলের হয়ে। এমনকি সাংবাদিকদের তারা বলেছে দিলদার বরাবর শাসক দলটাই করত।।
No comments:
Post a Comment